মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, বান্দরবান প্রতিনিধি ::
উখিয়া ও টেকনাফ এই দুটি উপজেলার বাইরে আরও প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায়। সরকারী বে-সরকারী ত্রাণ, চিকিৎসা, ওষুধ সবকিছু থেকেই তারা প্রায় বঞ্চিত। এখানে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থারও আগ্রহ কম।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে দোছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে ‘বাহির মাঠ’ এলাকায় একটি ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছে ৭৮টি রোহিঙ্গা পরিবার। চাল, ডাল, তেল ছাড়া অন্য কোনো ত্রাণ তাদের ভাগ্যে এখন পর্যন্ত জোটেনি।
ত্রাণ শিবিরটি অত্যান্ত দূর্গম। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে অটোরিকশায় করে যেতে হয় তিন কিলোমিটার দূরে কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়া বাজারে। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি অথবা ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেলে করে যেতে হয় ১৮ কিলোমিটার দূরে নাইক্ষ্যংছড়ির লেমুছড়ি বিজিবি সীমান্ত ফাঁড়ি এলাকায়। এরপর মোটর সাইকেল বা হেঁটে আরও তিন কিলোমিটার পথ পেরুলে দূর্গম পাহাড়ের বাহির মাঠ ত্রাণ শিবির।
পাহাড়ের ঢালুতে ৪০-৫০টি ঝুপড়ি ঘর। এসব ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ৭৮ রোহিঙ্গা পরিবারের। শিবিরে থাকা বেশির ভাগ শিশুর গায়ে জামা নেই ও ভুগছে নানাবিধ রোগে। খাবারের কষ্টে রয়েছে বলে তারা জানাই।
বাহির মাঠ ত্রাণশিবিরের একটি ঝুপড়িতে স্ত্রী ও ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন শামসুল আলম (৪৫)। তাঁর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কুমিরখালী গ্রামে। সেখানকার একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন তিনি। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তিনি পরিবার নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নেন এখানে।
শামসুল আলম বলেন, এখানে খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে। দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি নলকূপ স্থাপন করে দিলেও সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। পাহাড়ি একটি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে পানির চাহিদা পূরণ করছেন তাঁরা। নোংরা পানি খেয়ে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিবিরের বাসিন্দারা।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরু হওয়ার পরদিন ৭৮ পরিবারের ৩৬২ রোহিঙ্গা ৪৯ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি বাহির মাঠ এলাকার আশ্রয় নেয়। কয়েক দিন আগে এই শিবিরে জন্ম নেয় দুই শিশু। এখন এই ত্রাণশিবিরের বাসিন্দা ৩৬৪ জন। এর মধ্যে শিশু ১৭১, নারী ১০০ ও পুরুষ ৯৩ জন।
দুর্গম এই শিবিরের বাইরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে আরও দুটি রোহিঙ্গা ত্রাণশিবির রয়েছে। এর মধ্যে উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বড় ছনখোলায় রয়েছে প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা এবং সাপমারাঝিরি আশ্রয়শিবিরে থাকছে আরও তিন হাজার রোহিঙ্গা। এই দুটি শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও খুব একটা ত্রাণ পাচ্ছে না।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম সরওয়ার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাহির মাঠ ত্রাণশিবিরের রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। নাইক্ষ্যংছড়ির তিনটি শিবিরে থাকা সব রোহিঙ্গাকে উখিয়ার ত্রাণশিবিরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গাকে উখিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদেশি নাগরিক ও দাতা সংস্থার প্রবেশাধিকার সীমিত থাকায় বাহির মাঠে থাকা রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে অনেকে যেতে পারছেনা। সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব খারাপ। ফলে ওই শিবিরের ৩৬৪ জন রোহিঙ্গা ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রোহিঙ্গা নারী মাজেদা বেগম (৩৬) বলেন, আড়াই মাস ধরে এই ঝুপড়িতে আছেন তারা। ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো খেতে পারছে না। মিয়ানমারের কিছু মুদ্রা (কিয়াত) হাতে থাকলেও তা দিয়ে কিছুই কেনা যাচ্ছে না।
আরেক নারী তাহেরা বেগম (৫০) বলেন, এ পর্যন্ত তিন দফা চাল, ডাল, তেল পেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু মাছ, মাংস, তরকারি কিছুই নেই। খেতে না পেরে ছেলেমেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। চিকিৎসা, ওষুধ কিছুই নেই।
পাঠকের মতামত: